শৈবাল বিজ্ঞানের বা ফাইকোলজির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা কর।
শৈবাল বিজ্ঞানের বা ফাইকোলজির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা কর।
ফাইকোলজি বা শৈবালবিজ্ঞান -এর ইতিহাস অতি প্রাচীন। সম্ভবত শৈবাল সম্পর্কিত জ্ঞান ও শৈবালের সাথে পরিচিতি মানব-সভ্যতার উন্মেষ এর সমসাময়িক। রোমান, গ্রীক ও চীনা প্রাচীন সাহিত্যে শৈবাল সম্পর্কিত বিবরণ পাওয়া গেছে।
Limu নামের একটি শৈবাল হাওয়াই দ্বীপের অধিবাসীদের খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল অতি প্রাচীনকাল থেকেই । জলজ উদ্ভিদের প্রতি মানবগোষ্ঠীর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল সম্ভবতঃ খাদ্যান্বেষণের কারণে। আর তখন থেকেই শৈবালের সাথে মানুষের প্রথম পরিচয়। শৈবালের নাম চীনাদের কাছে সাও (Tsao), রোমানদের কাছে ফিউকাস (Fucus) এবং গ্রীকদের কাছে ফাইকোস (Phycos)। ফ্রান্সের উত্তর উপকূলবাসীরা জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির জন্য শৈবালকে সার হিসাবে ব্যবহার করত।
অতি প্রাচীনকাল থেকে শৈবালের সাথে মানুষের পরিচয় থাকলেও বিধিবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শৈবাল বিষয়ক পড়াশুনা এবং একটি বিজ্ঞান হিসাবে পঠন-পাঠন শুরু হয়েছিল অনেক দেরীতে। শৈবাল সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আমাদের জ্ঞানচর্চা শুরু সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে। লিউয়েন হুক এর অণুবীক্ষণ যন্ত্র খুলে দিল জ্ঞানচর্চার সোনালি সিংহদ্বার। খালিচোখে অদৃশ্য বস্তু নিশ্চয় দৃশ্যমান হলো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের পরকলার (lens) নিচে।
সভ্যতার ইতিহাসে সেটি এক অত্যুজ্জ্বল ঘটনা। তবু শৈবাল চর্চার ইতিহাসের গতি ছিল অত্যন্ত মন্থর। অষ্টাদশ শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ পর্যন্ত Fucus, Conferva, Ulva এবং Corallina ছাড়া আর কোনো শৈবাল সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। আঙ্গিক গঠন সাদৃশ্যের কারণে ভুল-ভ্রান্তি ও ঘটছিল শৈবালের তথ্য সংগ্রহে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, Chara একটি পরিচিত শৈবাল হওয়া সত্ত্বেও তাকে Equisetum নামক একটি টেরিডোফাইট এর গোষ্ঠীবদ্ধ করা হয়েছিল কেবল দৈহিক-গঠনের সাদৃশ্য দেখে।
১৭৫৪ খৃষ্টাব্দে লিনিয়াস (Linnaeus) নামক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ভুলক্রমে Hepaticae গ্রুপের উদ্ভিদকে শৈবাল হিসাবে ধারণা করেছিলেন । বর্তমান দিনে ফাইকোলজি বলতে যে বিজ্ঞানকে আমরা বুঝি, তার প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে প্রখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী A. L. De Jussieu এর হাতে। অণুবীক্ষণ যন্ত্র একটি উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাইকোলজি নিয়ে কাজে মেতে উঠেন এক ঝাঁক ইউরোপীয় বিজ্ঞানী।
শৈবাল বিজ্ঞানের ইতিহাস আসলে ফাইকোলজি বা অ্যালগোলজি নামের একটি নির্দিষ্ট শাখার ইতিহাস। এটি জীববিজ্ঞানের এমন একটি অংশ যা শৈবালের শ্রেণীবিন্যাস, গঠন, জীবনচক্র, পরিবেশগত ভূমিকা এবং ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করে। নিচে ধাপে ধাপে এর বিকাশের ইতিহাস তুলে ধরা হলো—
১. প্রাচীন যুগে শৈবাল সম্বন্ধে ধারণা
-
প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগেই মানুষ শৈবাল চিনত, কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে শ্রেণীবদ্ধ করত না।
-
প্রাচীন চীন, মিশর ও জাপানে খাদ্য ও ওষুধ হিসেবে শৈবালের ব্যবহার পাওয়া যায়।
-
আরিস্টটল (৩৮৪–৩২২ খ্রিষ্টপূর্ব) সমুদ্রতীরবর্তী উদ্ভিদের মধ্যে শৈবালও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, কিন্তু আলাদা শ্রেণী দেননি।
২. অণুবীক্ষণযন্ত্রের আবিষ্কারের পর (১৭শ শতক)
-
আন্তোনি ভ্যান লিউয়েনহুক (১৬৩২–১৭২৩) প্রথমবার অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে অণুজীব ও ক্ষুদ্র শৈবাল পর্যবেক্ষণ করেন।
-
১৬০০-এর দশকের শেষ দিকে শৈবালের গঠন, রঙ ও আকৃতি নিয়ে প্রাথমিক নোট তৈরি হয়।
৩. ১৮শ শতকের শ্রেণীবিন্যাসের যুগ
-
কার্ল লিনিয়াস (Carl Linnaeus, ১৭০৭–১৭৭৮) তার Species Plantarum (১৭৫৩) গ্রন্থে শৈবালকে ফ্লোরা বা উদ্ভিদরাজির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন, যদিও আলাদা শ্রেণী দেননি।
-
তখন শৈবালকে শুধু "অফ্লাওয়ারিং প্ল্যান্ট" বা "ক্রিপ্টোগাম" হিসেবে ধরা হত।
৪. ১৯শ শতকে বৈজ্ঞানিক বিকাশ
-
উইলিয়াম হেনরি হার্ভি (William H. Harvey) এবং জে. আগার্ড শৈবালের শ্রেণীবিন্যাস ও নামকরণে বিশাল অবদান রাখেন।
-
শৈবালের জীবচক্র, প্রজনন পদ্ধতি ও পরিবেশগত ভূমিকা নিয়ে প্রথম গভীর গবেষণা হয়।
-
এই সময়ে সামুদ্রিক শৈবালের ভাণ্ডার সংগ্রহ ও অ্যালবাম তৈরি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
৫. ২০শ শতকের বিপ্লব
-
অণুবীক্ষণ প্রযুক্তি ও ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ শৈবালের সূক্ষ্ম গঠন ও কোষের অঙ্গাণু পর্যবেক্ষণ সম্ভব করে।
-
ক্লোরোফিলের ধরণ ও রঞ্জকদ্রব্যের ভিন্নতা আবিষ্কারের মাধ্যমে শৈবাল শ্রেণীবিন্যাসে নতুন মানদণ্ড আসে।
-
সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীল-সবুজ শৈবাল) আসলে ব্যাকটেরিয়া, উদ্ভিদ নয় — এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬. আধুনিক যুগ (২১শ শতক)
-
মলিকুলার বায়োলজি ও ডিএনএ সিকোয়েন্সিং শৈবালের বিবর্তনীয় সম্পর্ক নির্ধারণে ব্যবহৃত হচ্ছে।
-
জলবায়ু পরিবর্তন, বায়োফুয়েল উৎপাদন, ওষুধ শিল্প এবং বায়োটেকনোলজিতে শৈবাল গবেষণা গুরুত্ব পাচ্ছে।
-
স্যাটেলাইট ইমেজিং দিয়ে বিশ্বব্যাপী শৈবাল ফুল বা algal bloom পর্যবেক্ষণ করা হয়।
শৈবাল বিজ্ঞানের ইতিহাস মূলত প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে—
প্রাচীন খাদ্য ও ঔষধি ব্যবহার থেকে শুরু করে আধুনিক ডিএনএ বিশ্লেষণ পর্যন্ত, শৈবাল গবেষণা জীববিজ্ঞান, পরিবেশবিদ্যা ও শিল্পক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখছে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url