বাসস্থানের উপর ভিত্তি করে শৈবালের শ্রেণিবিন্যাস
বাসস্থানের উপর ভিত্তি করে শৈবালের শ্রেণিবিন্যাস
প্রায় সব ধরনের আবাসস্থলে শৈবালকে জন্মাতে দেখা যায়। মাটি, পানি, পাহাড়ের ঢাল, গাছের বাকল, উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহের উপরিভাগে অথবা দেহাভ্যন্তরে, উত্তপ্ত মরু-প্রান্তর, উষ্ণ প্রস্রবণ অথবা মেরু অঞ্চলের বরফগলা পানি সর্বত্রই শৈবাল জন্মাতে সক্ষম।
শৈবাল তার জন্মস্থান থেকে বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে দূর-দূরান্তরে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন আবাসস্থলে অভিযোজনপূর্বক বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এসব বাহকের মধ্যে নদী ও সমুদ্রের ঘন জলস্রোত, বৃষ্টির পানির নিম্নমুখী ধারা, জলযান, মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর দেহ সংলগ্ন হয়ে, বায়ুপ্রবাহের কারণে নতুন নতুন আবাসস্থলে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে ।
বিভিন্ন ধরনের আবাসস্থলের ভিত্তিতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা শৈবালসমূহকে নিম্নে উল্লিখিত বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়।
১. জলজ শৈবাল (Aquatic Algae) : পানিতে বসবাসকারী কি শৈবালসমূহ জলজ শৈবাল নামে পরিচিত। কিন্তু পানির ধরন অনুসারে জলজ শৈবালগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়।
(ক) স্বাদু-পানির শৈবাল (Fresh water algae) : নর্দমা, নদী, নালা, পুকুর, খাল, বিল, হ্রদ ইত্যাদির লবণ-বিহীন পানিতে যেসব শৈবাল জন্মে, তারা স্বাদু-পানির শৈবাল নামে পরিচিত। Spiogyra, Volvox, Oscillatoria, Nostoc, Oedogonium, Chara ইত্যাদি স্বাদু-পানির শৈবালের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।
(খ) ঈষৎ লোনা পানির শৈবাল (Brakish water algae) : সমুদ্রগামী নদীর মোহনা, সাগর তীরবর্তী খাড়ি ও খালের মুখে নিয়মিতভাবে জোয়ার-ভাঁটা হয়। এছাড়াও মাঝে মাঝে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে সমুদ্রের লোনা পানি উপকূলবর্তী নদী-নালার ভিতরে প্রবেশ করে বলে এসব জলাশয়ের পানি ঈষৎ লোনা (Brakish)।
এসব এলাকার পানির লবণাক্ততা সমুদ্রের পানির লবণাক্ততার চেয়ে কম কিন্তু নদী ও খালবিলের স্বাদু পানির চেয়ে কিছুটা বেশি। এ ধরনের ঈষৎ-লবণাক্ত পানিতে যে সব শৈবাল জন্মে, তারাই ঈষৎ লোনা পানির শৈবাল (Brakish-water-algae) নামে অভিহিত হয়। Anabaena, Chlamydomonus প্রভৃতি শৈবালকে ঈষৎ লোনা পানির শৈবাল হিসাবে আখ্যায়িত করা যায় ।
২. লোনা পানির শৈবাল বা সামুদ্রিক শৈবাল (Marine Algae): সমুদ্রের লোনা পানিতে যেসব শৈবাল এর জন্ম হয়, তারা সামুদ্রিক শৈবাল বা লোনা পানির শৈবাল নামে পরিচিত। পানিতে যেখানে লবণের পরিমাণ হাজার ভাগের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ সেখানেই সামুদ্রিক শৈবাল ভালো জন্মে।
সাধারণত উপকূলের কাছাকাছি মাত্র ২% স্থান ফাইটোপ্ল্যাক্টন, সামুদ্রিক শৈবাল এবং ডায়াটম ডিনোফ্লাজেটস জাতীয় শৈবাল দ্বারা অধিকৃত থাকে । সাধারণ লিটোরাল জোন অর্থাৎ জোয়ারের পানি যে পর্যন্ত উপরে আসে এবং ভাঁটার পানি যে পর্যন্ত নিচে নামে তার মধ্যের জায়গাটুকু শৈবাল জন্মানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা। সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে সাধারণত Laminaria, Sargassum, Bangia, Caulerpa, Polysiphonia, Pandina, Rhodymenia ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য ।
৩. স্থলজ শৈবাল (Terrestrial Algae) : যেসব শৈবাল মাটিতে জন্মায়, তারা স্থলজ শৈবাল নামে পরিচিত।
সারা বছর ধরেই মাটিতে শত শত শৈবাল থাকলেও সাধারণত বর্ষা ঋতুতেই এরা বেশি করে চোখে পড়ে। কোন শৈবালের দেহে মিউসিলেজ থাকার কারণে বর্ষাকালে মাটি পিচ্ছিল হয়ে যায়। প্রেসকট নামক শৈবালবিদ মাটির উপরে বসবাসকারী সমস্ত শৈবালকে সম্মিলিতভাবে Edaphophytes নামে অভিহিত করেছেন ।
অন্যান্য কিছু শৈবালের বাসস্থান
১. হ্যালোফাইটিক শৈবাল ( Halophytic Algae): অধিক ঘনত্বযুক্ত লবণ পানিতে যেসব শৈবাল জন্মাতে সক্ষম তাদেরকে হ্যালোফাইটিক শৈবাল বলে।
এরূপ জলজ পরিবেশে দ্রবণের ঘনত্ব থাকে হাজার ভাগে একশ ভাগের বেশি। এই ঘনত্ব সাধারণ উদ্ভিদ শৈবাল বহিঃঅভিস্রবণের কারণে টিকে থাকতে পারে না। তবে কতিপয় শৈবাল যারা ঐ পরিবেশে সহনশীল যেমন- Chlamydomonas Chrenberghit ও Dunaliella-র প্রভৃতি বেঁচে থাকতে পারে ।
২. ক্রায়োফাইটিক শৈবাল (Cryophytic algae) : তুষার কিংবা বরফের উপর বসবাসকারী, শৈবালকে ক্রায়োফাইটিক (Cryophytic) শৈবাল বলা হয়। উদাহরণ- Cylindrocystic
৩. থার্মাল শৈবাল (Thermal algae) : উষ্ণ প্রস্রবণের গরম পানিতে যে সব শৈবাল জন্মে, তারা থার্মাল শৈবাল নামে পরিচিত। এ ধরনের শৈবাল ৫০° সে. থেকে ৭৩° সে. তাপমাত্রা বিশিষ্ট পানিতে জন্মাতে পারে। Round নামক শৈবালবিদ ৮৫° সে. তাপমাত্রায় কতিপয় সায়ানোফাইটিক শৈবালকে জন্মাতে দেখেছেন বলে রিপোর্ট করেছেন।
৪. এপিফাইটিক শৈবাল (Epiphytic algae) : শৈবালের উপর জন্মানো শৈবাল বা অন্যান্য উদ্ভিদ দেহের উপর জন্মানো শৈবালকে পরাশ্রয়ী বা এপিফাইটিক শৈবাল বলে। এরা আশ্রয়দাতা উদ্ভিদের দেহে আশ্রয় নিয়ে বেড়ে উঠে। স্বাদুপানি ও লোনাপানির অনেক শৈবাল এপিফাইটিক। Nostoc, Oscillatoia, Tolypotunix, Bulbochaete প্রভৃতি উদ্ভিদ এপিফাইটিক ।
৫. পরজীবী শৈবাল (Parasitic algae) : যে শৈবাল কোনো উদ্ভিদের উপর পরজীবী হিসাবে বাস করে, তাকে প্যারাসাইটিক শৈবাল বা পরজীবী শৈবাল বলা হয়। উদাহরণ- Cephaleuros নামক শৈবালটি চা গাছ ও ম্যাগনোলিয়া গাছে পরজীবী হিসাবে বাস করে। Ceratocolax, Callocolax, Phyllosiphox ইত্যাদি শৈবালগুলোও পরজীবী শৈবালের উদাহরণ।
৬. এন্ডোফাইটিক শৈবাল (Endophytic algae) : অন্য কোনো উদ্ভিদ দেহের অভ্যন্তরে যে শৈবাল বাস করে, তাকে এন্ডোফাইটিক (Endophytic) শৈবাল বলা হয়।
উদাহরণ-
(ক) Azolla এর দেহের মধ্যে Anabaena.
(খ) Cycas এর কোরালয়েড মূলের কর্টেক্স (cortex) অঞ্চলে Anabaena শৈবালের অবস্থান- Endophytic শৈবালের উদাহরণ।
অবশ্য Endophytic শৈবালগুলো নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে বলেই আশ্রয়দাতা উদ্ভিদটিও উপকৃত হয় । কাজেই Anabaena, Nostoc-কে মিথোজীবী শৈবালও বলা যায়।
৭. মিথোজীবী শৈবাল (Symbiotic algae) : যেসব শৈবাল ছত্রাকের সাথে একত্রে মিথোজীবী হিসাবে বসবাস করে উভয়েই উপকৃত হয়, সেসব শৈবালকে মিথোজীবী বা সিম্বায়োটিক শৈবাল বলা হয়। এসব শৈবাল লাইকেন এর অপরিহার্য উপাদান।
Trentepholia, Cephaleuros, Urococcus, Coccomyxa, Nostoc ইত্যাদি মিথোজীবী শেবালের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।
৮. এপিজয়িক শৈবাল (Epizoic algae) : যেসব শৈবাল কোনো টির প্রাণীর দেহের উপরিভাগে জন্মে, সেগুলো এপিজয়িক শৈবাল নামে অভিহিত হয়। শামুকের খোলস এর উপরে বসবাসকারী Cladophora, Crispata এপিজয়িক শৈবালের বিশিষ্ট উদাহরণ ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url